‘ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে এই কাছিমটি আগে কখনোই দেখা যায়নি। ওই এলাকায় এই প্রজাতির আরও কাছিম থাকতে পারে। এটি প্রজাতিটি সংরক্ষণে হয়তো নতুন পথ দেখাবে’
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ থেকে উদ্ধারকৃত ৪০ কেজি ওজনের মহাবিপন্ন বোস্তামী কাছিমটি (কচ্ছপ) মারা গেছে। বৃহস্পতিবার (১৪ মে) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে দিনাজপুর রামসাগর চিড়িয়াখানায় কচ্ছপটির মৃত্যু হয়।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে দিনাজপুর সহকারি বন সংরক্ষণ কর্মকর্তা শাহীন কবির ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “যে পুকুরের পাড় থেকে কচ্ছপটি ধরা পড়ে, সেখানে নাকি বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরা চলছিল। বন বিভাগের চিড়িয়াখানায় আনার পরও তার মুভমেন্ট (নড়াচড়া) ছিলো। এরপর কিছুটা নিথর হয়ে পড়লে ফোনে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করা হয়। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে এটা মারা যায়।”
এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তামলাই এলাকার আবু রায়হানের পুকুরের কিনারে কচ্ছপটিকে দেখতে পায় স্থানীয়রা। এ সময় তারা পুকুর মালিককে খবর দেয়। পরে পুকুর মালিক ও স্থানীয়রা কচ্ছপটিকে উদ্ধার করে উপজেলা প্রশাসনকে খবর দেয়।
পুকুর মালিক আবু রায়হান জানান, পুকুরটি শত শত বছর পুরোনো। এ পুকুরের পানি কখনও শুকায় না। এখান থেকে এর আগেও কচ্ছপ ধরা পড়েছে। সেগুলোর ওজর ১০-১৫ কেজির বেশি হবে না। কিন্তু তিনি জানার আগেই স্থানীয়রা সেগুলো মেরে ফেলেছে। এবার সেটি হতে দেননি।
আরও পড়ুন - ঠাকুরগাঁও থেকে মহাবিপন্ন বোস্তামী কাছিম উদ্ধার
খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা কচ্ছপটিকে তাদের জিম্মায় নিয়ে যায়। উপজেলা প্রশাসন দিনাজপুর বন বিভাগকে খবর দিলে রাতেই কচ্ছপটিকে নিয়ে যায় তারা।
এ বিষয়ে পীরগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী অফিসার রেজাউল করিম বলেন, “আমরা কচ্ছপটি ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে আসি। পরে বনবিভাগকে খবর দেই এবং রাতেই তাদের কাছে কচ্ছপটি হস্তান্তর করি। বনবিভাগ ও প্রাণীবিদেরা কচ্ছপটির উৎস ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে গবেষণালব্ধ মতামত জানাবেন।”
উদ্ধারকৃত কচ্ছপটির পরিচয় নিশ্চিত হতে ঢাকা ট্রিবিউনের হাতে আসা ছবি পাঠানো হয়েছিল বন বিভাগের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা জোহরা মিলার কাছে। ছবি দেখে তিনি প্রাণীটিকে বোস্তামী কাছিম (The black softshell turtle or Bostami turtle) হিসেবে শনাক্ত করেন।
তিনি জানান, বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, কচ্ছপের এই প্রজাতিটি কেবল চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারের পুকুরেই আছে। তবে ২০০৭ সালে পিটার গ্রাসবাগ নামে একজন প্রাণিবিজ্ঞানী ভারতের আসামে এই কচ্ছপটিকে খুঁজে পান। পরে ২০১০-১২ সালের মধ্যে ফেনীর মুহুরী নদী, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনার নদী-জলাশয়ে এই প্রজাতির কয়েকটি কাছিমের অস্তিত্ব শনাক্ত হয়। তবে ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে এই কাছিমটি আগে কখনোই দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন - ভাইরাল হওয়া প্রাণীটি চিতাবাঘ নয়, চিতা বিড়ালের বাচ্চা
তিনি বলেন, “এই প্রজাতির কচ্ছপের আয়ু ১০০ বছরের বেশি। এটি ৬০-৯৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। তবে মাজারে এক মিটার দৈর্ঘ্যের কাছিমও পাওয়া গেছে। যদিও অনেকে মনে করেন হজরত সুলতান বায়েজিদ বোস্তামী (র.) ইরান থেকে চট্টগ্রামে আসার সময় এ কাছিমগুলো নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এই কাছিমটি বাংলাদেশ অঞ্চলের নিজস্ব প্রাণী।”
জোহরা মিলা বলেন, “আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) ১৯৯৮ সালে পৃথিবীর অন্যতম বিপন্নপ্রায় প্রাণীর তালিকায় বোস্তামী কাছিমের নাম অর্ন্তভুক্ত করে। তবে ২০০২ সালে সংস্থাটি তাদের প্রাণীটিকে “মহাবিপন্ন” বলে ঘোষণা দেয়। দেশের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা)-২০১২ অনুযায়ী এই প্রাণীটি সংরক্ষিত। তাই এটি হত্যা বা এর কোনো ক্ষতি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।”
কচ্ছপটির মৃত্যুর খবরে দুঃখ প্রকাশ করে জোহরা মিলা বলেন, “ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে প্রথমবারের মতো বোস্তামী কাছিম পাওয়ার ঘটনা যে কোনো বন্যপ্রাণীবিদের জন্য আনন্দের খবর। কিন্তু কাছিমটির মৃত্যু আরও দুঃখজনক। তবে ওই এলাকায় এই প্রজাতির আরও কাছিম থাকতে পারে। এটি প্রজাতিটি সংরক্ষণে হয়তো নতুন পথ দেখাবে।”
আরও পড়ুন - বাঘ বেড়েছে সুন্দরবনে
মতামত দিন