প্রকাশ্যেই পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করলেও স্থানীয় প্রশাসনসহ পরিবেশ অধিদপ্তর কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে
জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় যত্রতত্র ইটভাটা গড়ে উঠেছে। ভাটা নির্মাণে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সরকারি দপ্তর, ঘনবসতি ইত্যাদি এলাকাগুলোয় যেমন পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে, তেমনই বায়ু দূষণজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি, হারিয়ে যাচ্ছে গাছপালা।
এলাকাবাসী জানায়, মেলান্দহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এলাকায় একটি, সরকারি কলেজ ও মৎস্য খামার সংলগ্ন একটি, উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন একটি, জালালপুর প্রাইমারি স্কুল সংলগ্ন একটি এবং কৃষিজমি ও বসতি এলাকায় চারটি ইটভাটা গড়ে ওঠেছে। এভাবে পুরো উপজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আরও অন্তত ৩০টি ইটভাটা।
ভাটা মালিকেরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃষকদের বিভিন্নভাবে ফাঁদে ফেলে ফসলি জমির মাটি (টপ সয়েল) কেটে নিচ্ছে। ফলে উঁচু জমি পরিণত হচ্ছে জলাশয়ে। ভাটা মালিকরা প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক মদদপুষ্ট হওয়ায় প্রকাশ্যেই পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করলেও স্থানীয় প্রশাসনসহ পরিবেশ অধিদপ্তর কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন - নদীকে দেখানো হলো খাস জমি, ইজারা দিলো জেলা প্রশাসন!
উপজেলার উদনাপাড়া, বজরদ্দিপাড়া ও বুরুঙ্গা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বসতি ও ফসলি জমির কাছাকাছি আটটি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। আশেপাশে জমিগুলোর মাটি কেটে সারি সারি পুকুরে পরিণত করা হয়েছে। কালো ধোঁয়ায় কমে গেছে ফসল উৎপাদন। সুপারি ও নারিকেলসহ বিভিন্ন মৌসুমী ফলের উৎপাদনও নেই বললেই চলে, যা-ও হয় তার অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন উদনাপাড়া গ্রামের কৃষক জয়নাল শেখ, কদ্দুছ মন্ডল, জাবেদ আলী ও সিদ্দিক মিয়া।
বজরদ্দিপাড়া গ্রামের কৃষক নূরূল হক, কাদের শেখ, শফিকুল ইসলাম জানান, তাদের বাড়ির পাশে ক্ষেতের মাঝখানে ইটভাটা। এতে কমেছে ক্ষেতের ধান উৎপাদন। সারি সারি নারিকেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে, কোনো ফল ধরছে না। ডাবের ভেতরে কোনো পানি থাকে না।
ওই গ্রামের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ভয়াবহ চিত্র। বজরদ্দিপাড়া ও বুরুঙ্গাপাড়ার ইটভাটার জন্য মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে উদনাপাড়া থেকে। মাটি কাটার জন্য বসানো হয়েছে বৃহৎ মেশিন। জমির উপরের স্তরের মাটি কেটে সারি সারি ট্রাক্টরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভাটাগুলোতে।
কৃষক মইনুল মিয়া, সুলতান শেখ, জব্বার মিয়া অভিযোগ করে বলেন, তাদের জমির মাটি বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কারণ পাশের ক্ষেতের মালিক মাটি বিক্রি করে দেওয়ায় তার ক্ষেতে পানি দেওয়া যায় না। ধানের ক্ষেতের পানি সব নেমে যায়। বারবার ক্ষেতের আইল ভেঙে সীমানা হেরফের হয়ে যায়। তাই জমি বাঁচাতে ক্ষেত নষ্ট করে পুকুর করতে তিনি বাধ্য হন।
আরও পড়ুন - নওগাঁয় কৃষি জমির মাটি যাচ্ছে ইট ভাটায়
একই রকম ফাঁদে পড়েছেন পাশের গ্রামের কৃষক আয়নাল হক, হায়তুল্যা মিয়া, রহমতুল্ল্যা, গিয়াস মিয়াসহ অনেকে। কৃষক মেহের আলী জানান, ইটভাটার মালিকরা পানির দামে মাটি নিচ্ছে। এক হাজার সিএফটি মাটি মাত্র ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
বিষয়টি খতিয়ে দেখতে এক ইটভাটার মালিককে প্রশ্ন করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “যখন পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন আসে তখন আমরা, ইটভাটার মালিকেরা কিছু টাকা ধরিয়ে দেই, এতেই সব ঝামেলা মিটে যায়।”
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জামালপুর জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অফিস নেই। জেলাটিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় ময়মনসিংহ থেকে।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মোবাইল ফোনে ময়মনসিংহ পরিবেশ অধিদপ্তর অফিসে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের ডেপুটি পরিচালক ফরিদ আহমেদ ছুটিতে আছেন। কিন্তু যিনি কলটি রিসিভ করেছেন, তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং প্রয়োজনীয় কথা বলতে অনুরোধ করেন।
আরও পড়ুন - ‘বোমা মেশিনের আঘাতে’ হুমকির মুখে পঞ্চগড়ের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য
এ সময় টাকা দিয়ে “ঝামেলা” মেটানোর অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিষয়টির উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, “অবৈধ ইটভার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে এবং এই অভিযান চলবে।” এরপরই মোবাইল ফোনের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।
এ ব্যাপারে জামালপুর উন্নয়ন সংঘের পরিচালক ও পরিবেশবাদী ও মানবাধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, “ইটভাটায় জন্য এভাবে মাটি নিয়ে যেতে থাকলে আবাদযোগ্য ১০ শতাংশ জমিও থাকবে না। এতে পরিবেশ বিপর্যয়সহ খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে। তাছাড়া জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ইটভাটার নিয়ম রক্ষা জরুরি।”
মেলান্দহ উপজেলা নির্বাহী অফিসার তামিম আল ইয়ামীন বলেন, “মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জালালপুর স্কুল সংলগ্ন ইটভাটা ও পল্লী উন্নয়ন একাডেমির পাশের ইটভাটাটি নির্মাণ স্থগিত করতে বলা হয়েছে।”
তবে চলমান অন্যান্য ইটভাটার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
আরও পড়ুন - বনরুই পাচার ও বিলুপ্তি ঠেকাতে সরকারের পদক্ষেপ কি যথাযথ?
মতামত দিন