বাংলাদেশি পাসপোর্টে বিদেশে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা। তিন খণ্ডের ঢাকা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রথম খণ্ড পড়ুন।
মিয়ানমার থেকে কয়েক দশক ধরেই পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাসিন্দারা। গত বছর ২৫ আগস্ট থেকে দেশটির সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের পরিমাণ বাড়লে জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পার হয়ে আসে জনগোষ্ঠীটির লাখ লাখ মানুষ। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’এর পরিসংখ্যান মতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে কমপক্ষে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের একটা অংশ যে কোনোভাবেই পেয়েছেন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে অবস্থান করছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সংখ্যাটাও কম নয়। জানা গেছে, বিদেশে পাড়ি জমানো রোহিঙ্গাদের এই সংখ্যাটা কমবেশি ২ লাখ ৫০ হাজার। বিদেশে বসবাসকারী এমনই কয়েক রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা ট্রিবিউন। সেখানে উঠে এসেছে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিভিন্ন চিত্র।
বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে পরে বিদেশে পাড়ি দেওয়া এমনই একজন রোহিঙ্গা মোশাররফ মিয়া। ২০০১ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পরিবারকে নিয়ে পালিয়ে আসেন তিনি। আশ্রয় নেন কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে। এরপরে কয়েক মাসের মধ্যেই কক্সবাজারের একটি খ্যাতনামা রেস্টুরেন্টে চাকরি জোগাড় করেন মোশাররফ। শুধু তাই না। স্থানীয় বাসিন্দা ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে নিজের পরিচিতিও বাড়িয়ে নেন তিনি।
পরে ২০১২ সালে মিথ্যা তথ্য ও ঠিকানা দিয়ে বাংলাদেশি পরিচয়পত্র নেন মোশাররফ। সেই পরিচয়পত্র আর কিছু কৌশল ব্যবহার করে পেয়ে যান বাংলাদেশের পাসপোর্ট। তারপর সৌদি আরবে বসবাসরত কয়েকজন রোহিঙ্গার সহায়তায় শ্রমিক ভিসায় পাড়ি জমান সেখানে। বর্তমানে সৌদিতেই আছেন তিনি।
মোশাররফের স্ত্রী মোসাম্মাৎ খাদিজা। ঢাকা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতা হয় খাদিজার। কক্সবাজার শহরে দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। তারও রয়েছে বাংলাদেশি পরিচয়পত্র। আর মোশাররফ-খাদিজার দুই ছেলেই জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। কক্সবাজারের স্কুলে পড়াশোনা করছে তারা।
স্বামীকে নিয়ে জানাতে গিয়ে খাদিজা বলেন, ‘আমাদের কিছুই করার ছিলো না। শুধু ভালোভাবে ও নিরাপদে বেঁচে থাকার জন্য আমরা এটা করেছিলাম। এখন আমার স্বামী প্রতি ছয় মাসে বেশ ভালো পরিমাণের টাকা পাঠান এবং আমরা এখন বেশ স্বস্তিতে আছি।’
খাদিজার ছোটভাই শহিদুল্লাহও (২৫) রয়েছেন কক্সবাজারে। ২০১৩ সাল থেকে কক্সবাজারের একটি মাদরাসায় পড়ালেখা করছেন তিনি। শহিদুল্লাহ বলেন, ‘আমি কক্সবাজারে লেখাপড়ার জন্য আসি। আমাদের গ্রামের অনেক বাসিন্দাই বছরের পর বছর ধরে পড়ালেখার জন্য এখানে আসে। তারপর অনেকেই রাখাইনে ফিরে যায়, অনেকেই যায় না। যেসব রোহিঙ্গারা ফিরে যান না, তারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড় করে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন।’
‘এখন আমিও একটি পাসপোর্ট জোগাড় করার চেষ্টা করছি। কারণ, আমার দুলাভাই বলেছেন, আমি যদি পাসপোর্ট জোগাড় করতে পারি, তাহলে আমার জন্য কিছু করতে পারবেন তিনি।’
কুতুপালংয়ের নিবন্ধিত একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা কাজল সওদাগর (৪৫)। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন তিনি। ২০০০ সালের আগেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানান তিনি। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে ছিলেন কাজল।
বর্তমানে কুতুপালংয়ে দুটি দোকানের মালিক কাজল। চেষ্টা করছেন আবারও শ্রমিক ভিসা নিয়ে বিদেশ যাওয়ার। তবে চলতি সময়ে ভিসা পাওয়া খুবই কঠিন বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশি পাসপোর্টে মালয়েশিয়া যান রোহিঙ্গা সেলিম (২৯)। তবে কাগজপত্র ভুয়া হওয়ার কারণে দেশটির সরকার তাকে ফেরত পাঠায়। তবে হাল ছাড়েননি সেলিম। বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিয়ে অন্য কোনো মুসলিম দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।
শুধু কাজল, সেলিম বা মোশাররফই নয়। বাংলাদেশি পাসপোর্টে বিদেশে কর্মরত রোহিঙ্গার সংখ্যা কমবেশি ২ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে ২ লাখ রোহিঙ্গা বিদেশ গিয়েছেন গত দুই বছরেই। কীভাবে বাংলাদেশের পাসপোর্ট পাচ্ছেন রোহিঙ্গারা? কারাই বা তাদের সহযোগীতা করছে এ বিষয়ে? এসব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে ঢাকা ট্রিবিউন। জানবেন এই প্রতিবেদনের পরবর্তী পর্বে।
মতামত দিন